ভবঘুরে ।। পর্ব-৮ ।।

দিন বদলেছে। মহল্লার সিকিউরিটি গার্ডদের কাজ রাত জেগে পাহারা দেয়া। কিন্তু স্মার্ট ফোনের কল্যানে তারা ঘুমাতে পারছে, পাহারা দিচ্ছে যুবক যুবতীরা। প্রতিটা ফ্ল্যাটেই কেউ না কেউ জেগে আছে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে। হেড ফোন কানে দিয়ে যে ফিসফিস করা বলছে, তারও হাতে ফোন। হেড ফোনে কথা হচ্ছে, আর হাতে চোখ দিয়ে মোবাইল ব্যবহার করছে। ঠিক বেলকুনিতে বসে আমি যেমনটা কানে হেডফোন গুজে দিয়ে হাতে টাইপ করে যাচ্ছি। রাতের এই সময়টা কিছু লেখার
জন্য ভালো। কেউ মনোযোগ নষ্ট করতে পারে না। আলোও কম, বেশি আলো হলে আবার আলো চোখের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
.
বেলকুনিটা বেশ ছোট। ঢাকার বাড়িওয়ালারা বাড়ি বানায় ভাড়া দেয়ার জন্য, বসবাসের জন্য না। কোন রকম রুম বানাতে পারলেই ভাড়া। নামে মাত্র বেলকুনি বানিয়ে ভাড়া কিছুটা হলেও বাড়াতে পারছে। বেলকুনিতে কেউ দাড়াতে, বসতে পারুক কিংবা না পারুক তা ভাবার সময় নেই। নীলা যখন আসতো তখন দুজন মুখোমুখি হয়ে দাড়ানো যেতো না। পাশাপাশি দাড়িয়ে আকাশ দেখতাম। মেসে মেয়েদের আসা পুরোটাই নিষেধ ছিলো, কিন্তু ওকে মেসের সবাই চিনতো। ওর একটা ভালো গুণ সবার সাথে খুব দ্রুত মিশে যেতে পারতো। যে কারণে আমার পরিচিত মহলে ওর বেশ জানাশুনা ছিলো। রুমমেটরাও নীলাকে বেশ পছন্দ করতো। আর পছন্দ করবেই না বা কেন, দেখতে শুনতে ভালো, আচার ব্যবহারও। মাঝে মাঝে এটা সেটা রান্না করে নিয়ে আসতো। মাসের শুরুতে কখনো আসলে মিল হিসাবও করে দিয়ে যেতো। এসব কারণেই বাসায় নীলার অবাধ প্রবেশে কারো কোন প্রশ্ন ছিলো না। রুমমেটরা নীলার আসল নামটাও জানতো। যদিও তা অনেকদিন পরে জেনেছে।
.
বেলকুনিটা ছোট বলে নীলার কোন ক্ষোভ ছিলো না। এর কারণ হয়তো দক্ষিনমুখী হওয়ার কারনেই। গ্রীলে হাত রেখে নীল আকাশ দেখা যেতো। সকালের সূর্য, সন্ধ্যার গোধুলী, কিংবা রাতে চাঁদ। বৃষ্টি হলে বাইরে হাত দেয়া লাগতো না, গ্রীলের উপর হাত রাখলেই হাত ভিজে যেতো। খুব বেশি বৃষ্টিতে বেলকুনিতে দাড়িয়ে নীলার সাথে অনেক ভেজা হয়েছে, হয়েছে চায়ের আড্ডাও। চা অবশ্য নীচের দোকান থেকে আনা হতো। ব্যাচেলরদের সবাই প্রচন্ড চা খোড় হলেও এদের বাসায় চা বানানো যায় না। চিনি থাকলে চা থাকে না, চা থাকলে দুধ থাকে না। আবার সবকিছু থাকলে পাতিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
সিগারেট খাওয়াটা নীলা প্রচন্ড অপছন্দ করলেও বেলকুনিতে দাড়িয়ে রাতের আকাশের তারা দেখতে দেখতে সিগারেট জ্বালালে একটুও রাগ করতো না। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই দিয়াশলাই এগিয়ে দিতো। আর বলতো- রাতে একটা খাবে, এটাই শেষ কিন্তু। আর কাল থেকে কমিয়ে দিবে। শেষ যে বার এখানে দাড়িয়ে আকাশ দেখছি, দিনটা ছিলো বেশ আলাদা। নীলা যখন রিক্সা করে গলির রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতো, আমি তাকিয়ে থাকতাম। নিচে নেমে কখনোও নিয়ে আসতাম না, ও যখন সিঁড়িতে পা ফেলে উঠতো, আমি দরজা খুলে শব্দ শুনতাম। শেষবার রিক্সা থেকে নামতে গিয়ে ওর খুব পছন্দের একটা শাড়ি রিক্সার সিটের একটা পেরেকে লেগে ছিঁড়ে যায়। ওই দিনটাই ছিলো বেশ ভিন্ন একটা দিন। দুজনই অজানা কোন ভয়ে ছিলাম।
.
আওয়াজ তোলা একটা গাড়ীর শব্দ একটু অবাক হয়ে যাই। মহল্লার গলিতে গাড়ীর খুব বেশি চলাচল নেই। রাতের এই সময়টায় রিক্সাও দেখা যায় না। ঠিক নিচে একটা টুলে বসে সিকিউরিটি গার্ড ঘুমাচ্ছে। ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছে, ঝুলতে ঝুলতে প্রায় নিচে পরে যাচ্ছে যাচ্ছে অবস্থায় ঘুম ভেঙ্গে আবার জেগে ওঠে। বেলকুনির গ্রীলের ঠিক মাঝে একটা জানালার মত। জানালার মত বলতে ওই অংশটা খোলা যায়। একটা স্বাভাবিক দেহের যে কোন মানুষ ওই পাল্লাটা খুলে বের হতে পারবে। আগুন বা অন্যকোন দূর্ঘটনার সময়ে পাল্লাটা ইমারজেন্সী এক্সিট হিসাবে ব্যবহারের জন্য দেয়া হলেও এই মুহর্তে মনে হচ্ছে ওটা খুলে বাইরে ঝাঁপ দেয়ার জন্যই হয়তো। ঝাঁপ দিয়ে খুব বেশি লাভ নাই। ঢাকা শহরের এইসব ৫ তলা থেকে লাফ দিয়ে আপনি কখনোই আত্মহত্যা করতে পারবেন না। ডিস লাইনের, টেলিফোন লাইনের, ইন্টারনেট লাইন আর  বৈদ্যুতিক কভার ক্যাবল কোনভাবে না কোনভাবে আপনাকে আটকে রাখবেই।
.
একঝাঁপটা বাতাস চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। একবার নীলা বলেছিলো, তোমার চুল আরেকটু বড় হলে আমি নিজ হাতে ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে দিবো, সেই থেকেই চুলগুলো বড় হচ্ছে। ব্যান্ডগুলো টেবিলের উপর একটা মোটাকাগজের বক্সে পরে আছে। নীলার খুব পছন্দের রঙ্গের অনেকগুলো।
মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, বাতাস বেড়ে যাচ্ছে। আকাশ অন্ধকার, চাঁদটা তো অনেক আগেই হারিয়েছে।